সততার মূল্য - ১ম পর্ব


                লিখেছেন: দেবজ্যোতি দে

পশ্চিমবঙ্গের মূর্শিদাবাদ জেলার প্রত্যন্ত্ একটি ব্লকে অর্থাৎ পঞ্চায়েত সমিতিতে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (অবর সহ বাস্তুকার) হিসাবে সরকারি চাকরি পেয়ে প্রথম পোস্টিং -এ বছর ২৫ এর তরুণ ছেলেটি যখন জয়েন করলো তখন ছেলেটির দু-চোখ ভরা স্বপ্ন। যা যা সে পড়েছে এতো দিন সেটাকে মানুষের উপকারে কাজে লাগাবার দিন আজ চলে এসেছে। কাজে যোগদানের পূর্বে সে শুনেছে ব্লকের অভ্যন্তরে যতগুলি গ্রাম রয়েছে সেগুলোর যাবতীয় উন্নয়নে (Development) এর কাজে তার ভূমিকা থাকবে, এবং এর ফলে বিপুলসংখ্যক মানুষের উপকারে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকবে এটা মনে করেই তার মন শিহরিত হচ্ছিল। এইরকম পরিস্থিতিতে জয়েন করার কিছুদিন পরে একটি ফ্লাডসেল্টারের (গ্রামে বন্যার সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাধারন মানুষকে যেখানে সাময়িক ভাবে থাকতে দেওয়া হয়) কাজের সাইট থেকে ফিরে ব্লকে ইঞ্জিনিয়ারদের ঘরে তার জন্য নিদৃিষ্ট চেয়ারে এসে বসার সাথে সাথেই অফিসের গ্রুপ-ডি স্টাফ এসে তাকে জানালো যে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ম্যাডাম ডাকছেন। আগে সভাপতির সাথে এক আধ বার কথা হলেও কাজ সংক্রান্ত বিষয়ে এই প্রথমবার কথা হবে তাই ভেবে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কিছুটা বিচলিত হয়ে সভাপতির ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। তিনি সভাপতির ঘরে যখন পৌছালেন  তখন সেখানে চাঁদের হাট পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, বিভিন্ন দফতরের কর্মাধ্যক্ষগন (পঞ্চায়েত সমিতির পদাধিকারীগন) এবং যে রাজনৈতিক দল পঞ্চায়েত সমিতির ক্ষমতায় আছে সেই দলের দলীয় কর্মকর্তারা, কিন্তু একি!!! সভাপতি জন্য নিদৃিষ্ট চেয়ারে সভাপতি না বসে সেখানে চেয়ার দখল করে বসে আছেন সভাপতির স্বামী আর সভাপতি তার পাশের চেয়ারে বসে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মনে মনে ভাবেন সভাপতির স্বামী তো জনপ্রতিনিধি নন তার স্ত্রী জনপ্রতিনিধি ও সভাপতি, তাহলে কোন যোগ্যতায় তিনি সভাপতির চেয়ার দখল করে আছেন??? হতবিহ্বল ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ঘোর কাটলো সভাপতির স্বামীর গুরুগম্ভীর স্বরে, তিনি বললেন - "ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, আপনি যে যে কাজগুলোর Inspection করছেন সেগুলো নিয়ে আমাদের কাছে প্রচুর অভিযোগ আসছে, আপনি কাজের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কড়াকড়ি করছেন, কাজের সিডিউল গ্রামের ছাপোষা মানুষদের বিতরণ করে তাদের কাজ বুঝে নিতে গ্রামের মানুষদের ক্ষেপিয়ে তুলছেন, কাজ শেষে কন্ট্রাক্টরদের ফুল বিল দিচ্ছেন না। এখানে যেসব কন্ট্রাক্টররা কাজ করে তারা সকলেই আমাদের দলীয় কর্মী, আপনার কড়াকড়ির ফলে তাদের ব্যবসা করতে খুবই অসুবিধা হচ্ছে, তাই আপনাকে জানাছি আপনি এইসব বন্ধ করুন" বলে তিনি থামলেন।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তো হতবাক, কি উত্তর দেবে ভেবে পেলেন না, তিনি যেটা করতে চাইছেন সেটা তো মানুষের সার্থে, তাতে এদের কেন অসুবিধা?? শুধু নিজেদের লোককে লাভবান করা??? আর যারা ভোট দিয়েছে এদের?? ভোটদাতাদের কে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এনারা ভোটের আগে?? সেগুলোর কি কোনো দাম নেই। এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে একরাশ নিরাশা গ্রাস করে তাকে। কোন জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে আসেন তিনি।
এরপরেও দমানো গেলোনা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে, তিনি যথারীতি নিয়মমাফিক বিল্ডিং, রাস্তার কাজ করাতে লাগলেন এবং কন্ট্রাক্টর মহলের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ বিভিন্ন ভাবে আসতে থাকলো তার উপরে। এরমধ্যে একদিন একটি রাস্তার কাজ পরিদর্শনে গিয়ে রাস্তা ঢালাই এ যে কনক্রিট ব্যবহার হচ্ছিল তার মান যাচাই করে পুরো কনক্রিট ব্যাচটি রিজেক্ট করার জন্য কন্ট্রাক্টর নিযুক্ত ভাড়াটে গুন্ডা প্রায় ২০০ মিটার দূর থেকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের গাড়ি লক্ষ্য করে ছররা বন্দুক (মাস্কেট) দিয়ে গুলি চালালো কিন্তু মাস্কেটের রেঞ্জ খুব বেশি নয় তাই গুলি পৌছালো না ইঞ্জিনিয়ার সাহেব পর্যন্ত। গ্রামবাসীদের ছেলেটিকে ধরে ফেলায় সেবারের মতো ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এলাকা ছাড়তে পারলেন কিন্তু অফিসে না ফিরে তিনি থানায় গিয়ে "জেনারেল ডাইরি" করলেন সেই কন্ট্রাক্টর ও ঐ গুন্ডার বিরুদ্ধে। অফিসে ফেরার পরে অনান্য স্টাফরা সতর্ক করলো ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে, বললো প্রান বাঁচিয়ে যা কিছু করতে। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও উপদেশ দিলেন - "দেশোদ্ধার করতে গিয়ে প্রানটা না হারিয়ে ফেলেন আপনি, এখানে বেশিরভাগ কন্ট্রাক্টরই বর্ডারে বেআইনি মাল পাচারে যুক্ত, কাউকে মেরে অন্য দেশে চলে যাওয়াটা এদের জলভাত। আপনি কিন্তু বেশি সাহস দেখাচ্ছেন"
এরমধ্যে অফিসে ইঞ্জিনিয়ারদের উপর কাজের চাপ কমাতে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার (Contractual ) কে ব্লকে নেওয়ার ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিলো পঞ্চায়েত সমিতি, সেই জন্য ইন্টারভিউ হলো সেখানে বিডিও সাহেব, সমিতির সভাপতি ও ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছিলেন ২ জনের ইন্টারভিউ এর পর খুব একটা পছন্দ না হলেও তাদের মধ্য একজনকে চাকরি দেওয়ার ব্যপারে সিদ্ধান্ত হলো। ইন্টারভিউ এর দিন রাতে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব যে কলেজ থেকে পড়তেন সেই কলেজের একজন শিক্ষকের সাথে ফোনে কথা হচ্ছিলো ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের। শিক্ষকমশাই হঠাৎই বললেন কলেজের একটি ছেলে আছে, ২ বছর হলো কলেজ থেকে পাশ করেছে, ছেলেটা একটা কাজের জন্য ওনাকে বারবার বলছে, তাই ছেলেটি কে যদি একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায় তবে ভালো হয়। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব শিক্ষকমশাই কে বললেন - "আগামীকালই ঐ ছেলেটিকে আমার অফিসে পাঠান, আমি ওকে একটা কাজ দিতে পারবো"
পরেরদিন যথারীতি ছেলেটা দেখা করলো এবং বিডিও এবং সভাপতির সাথে কথা সাপেক্ষে ছেলেটির চাকরি হলো। সদ্য চাকুরি প্রাপ্ত ছেলেটির "দাদা-দাদা" ডাক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে খুবই তৃপ্ত করছিলো তদুপরি অন্তত একজনের চাকুরির ব্যবস্থা তিনি করতে পেরেছেন বলে মনটা খুশিতে ভরে গেলো। এইভাবে কিছুদিন ভালোই চলছিলো নতুন ছেলেটিকে সমস্ত কাজ নিজ হাতে শিখিয়ে নিলেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। কিন্তু  কয়েকমাস পর থেকেই তিনি অনুভব করলেন ছেলেটি ক্ষমতাসিন রাজনৈতিক দল ও পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও কর্মাধ্যক্ষদের সাথে অত্যাধিক সখ্যতা শুরু করেছে এবং বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানাতে পারলেন ইঞ্জিনিয়ারিং দপ্তর থেকে যে সকল টেন্ডার হয় তার গোপন নথি বাইরে ফাঁস হচ্ছে, এই খবর পেয়ে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নতুন ছেলেটির সাথে আলাদাভাবে ২/৩ বার কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করলেন পঞ্চায়েত সমিতির ফাঁদে পা না দিতে কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হলো না বরং হঠাৎ একদিন পঞ্চায়েত সমিতি সিদ্ধান্ত নিলো ছেলেটির মাইনে একধাক্কায় ১০০০০ টাকা বাড়িয়ে দিলো। এবার ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের কাছে সমীকরণটা পরিষ্কার হলো। এদিকে নতুন ছেলেটির কার্যকলাপ অফিসের সকলেই আস্তে আস্তে জানতে পারলো এবং তারা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কে বলতো  - "দেখো তুমি খাল কেটে কেমন কুমির নিয়ে এসেছো"
ইতিমধ্যে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির স্বামী বেনামে ২৫ লক্ষ টাকার একটি কংক্রিটের রাস্তার কাজের বরাত আদায় করেছে, এর আগে অনেকবার সে বিভিন্ন গ্রাম পঞ্চায়েতে ও পঞ্চায়েত সমিতিতে বেনামে কাজ নিলেও ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের আন্ডারে কাজ করেননি, কিন্তু এবার কপাল খারাপ কাজটির পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পড়লে এই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের স্কন্ধে।
কাজটি শুরু হওয়ার পর থেকেই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সাথে রোজই কিছুনা কিছু বিষয়ে কন্ট্রাক্টরের অশান্তি লেগেই থাকে, আজ ইট খারাপ তো কাল বালি খারাপ পরশু লোকাল সিমেন্টের ব্যবহার নিয়ে। শনিবার ও রবিবার অফিস ছুটির দিনে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অনুপস্থিতিতে কোনোরকম ঢালাই এর কাজ না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, কিন্তু তার কথার অমান্য করে ২ টি ছুটির দিন লোকাল সিমেন্ট দিয়ে নিম্নমানের ঢালাই এর কাজ করেন ঐ কাজের কন্ট্রাক্টর তথা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির স্বামী। সোমবার অকুস্থলে গিয়ে কাজের মান নিয়ে অসন্তুষ্ট ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বিডিও সাহেব কে লিখিত ভাবে অভিযোগ করলেন এবং ঐ ২ দিন তার অবর্তমানে যতটা কাজ হয়েছে তা ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করলেন। এই খবর অফিসময় হতেই অফিসে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়লো। সভাপতির স্বামী ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে অফিসের মধ্যেই হুমকি দিলেন - "আপনি অভিযোগ তুলে না নিলে আপনি মার্ডার হয়ে যাবেন, আপনার বাড়ির লোক বডিও খুঁজে পাবেনা"
এরপর ডাক পড়লো বিডিও সাহেবের কাছে, তিনি জনান্তিক  ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কে বললেন -"আপনি অভিযোগপত্রটি তুলে নিন, আমার উপর রাজনৈতিক চাপ আছে, রাস্তাটা ওরা ভেঙে নতুন করে করতে চাইছে না, কিছুটা রিপেয়ার করতে রাজি হয়েছে, আপনি বাধা দিয়েন না"। কিন্তু কর্তব্যে অবিচল ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কোনো কিছুই পাত্তা দিলেননা। পরের দিন তিনি আবার চিঠি দিলেন বিডিও সাহেব এবং ঐ এলাকার SDO (সাব ডিভিশনাল অফিসার) সাহেবকে, লিখলেন - "তৃতীয় কোনো পক্ষকে দিয়ে টেস্ট করে দেখা হোক রাস্তাটা সঠিক ভাবে হয়েছে কিনা?? যদি ঠিক থাকে তাহলে আমি অভিযোগপত্র তুলে নেবো, নাহলে রাস্তাটা ভেঙে নতুন করে করতে হবে"।
কিন্তু ঘটনার ২ দিন পর থেকেই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেলো, অফিস থেকে ফেরার পথে নৌকায় তার পাশে এসে ২টি ছেলে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের দিকে উদ্দেশ্য করে কথোপকথন করে - "আচ্ছা এখন যদি একজনকে নৌকা থেকে ফেলেদি তবে কি সেটা দূর্ঘটনা বলে চালানো যাবে??" এছাড়া সরাসরি কতবার যে তাকে অফিস যাতায়াতের পথে অথবা ফোনে হুমকি দেওয়া হয় তা গুনে বলা যাবে না। এর মধ্যে সপ্তাহের শেষে একটি সাইটের কাজ পরিদর্শন করে অফিসের গাড়িতে করে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেব সঙ্গী সেই ছেলেটি যার চাকরির ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছিলেন এবং আর একজন অফিস স্টাফ। কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পরে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব শুনলেন পিছনের সিটে বসা নতুন ছেলেটি খুব আস্তে আস্তে কাউকে বলছে -"আর ১০ মিনিট লাগবে স্টেশন পৌঁছাতে... হ্যাঁ ঐ রাস্তা দিয়েই যাচ্ছি... " 
একটু বাদে গাড়ি স্টেশনে সবেমাত্র পৌঁছেছে, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব গাড়ি থেকে নামা মাত্র ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের পরিচিত একজন কন্ট্রাক্টর যে সর্বক্ষন সভাপতির স্বামীর সঙ্গী সে পথ আগলে দাঁড়ালো, তার হাতে একটা 'মাস্কেট', লোকটি মাস্কেটটিকে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মাথায় ঠেকালো ও আর  একহাত দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের জামার কলার ধরে বললো - "কিরে তুই বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিস না?? এখন যদি তোর মাথা ফুটো করে দি কে বাঁচাবে তোকে?? সামনের সপ্তাহে অফিস খুললেই তুই অভিযোগ তুলে নিবি নাহলে তোর লাশ ফেলে দেবো"
চলবে.........

Comments

Post a Comment